কুমিল্লার বরকামতা’র খাদি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে খাদি’র গৌরবময় ঐহিত্য বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশ জুড়েই সমাদৃত নয়,- ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বরকামতার খাদি’র পোশাক ব্যবহৃত হচ্ছে। আজকের ‘খাদি’ নামে পরিচিত তাঁত শিল্পে তৈরী এসব কাপড়ের তৎকালিন সময়ে কোন নাম ছিল না। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীজির হাতে কাটা সুতা দিয়ে তাঁতে তৈরি খদ্দর কাপড় তুলে দিলে তিনি এইটিকে স্বদেশী কাপড় হিসেবে এবং গর্তে (খাদে) বসে এই কাপড় তৈরি করা হয় বলে ওই কাপড়ের নামকরণ করে দিয়েছিলেন ‘খদ্দর’ কাপড়। সেই থেকে এই শিল্পের উৎপাদিত কাপড় বিশ্বব্যপী খুব দ্রুত প্রসার এবং খদ্দর থেকে খাদি নামে পরিচয় লাভ করে। ওই একই সময় মহাত্মা গান্ধীর আহবানে বৃহত্তর ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে বিদেশি পণ্য বর্জন করে দেশিয় পণ্যে ‘মোটা কাপড়, মোটা ভাত’ ব্যবহারের জন্য ডাক উঠেছিল। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে ভারতের অভয়াশ্রম পরিচালিত ‘নিখিল ভারত কার্টুর্নি সংঘ’র হাতে কাটা চরকায় সুতা ও তকলীতে কাপড় তৈরির কাজ শুরু হয়। চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা শৈলেন্দ্র নাথ গুহ’ বরকামতায় এসে তারই তত্বাবধানে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার কাঠেরপুল সংলগ্ন বরকামতায় (বর্তমান চান্দিনা) চাঁন্দারপাড়ে গড়ে তোলেন ‘শৈলেন্দ্রনাথ গুহের গ্রামীণ খাদি’ কারখানা। ওই কারখানায় নিজেই ডায়িং মাষ্টার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯০১ সালে চট্রগ্রামের পটিয়ায় জন্ম নেয়া শৈলেন্দ্রনাথ গুহ যৌবনের শুরু থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত (শৈলেন্দ্রনাথ গুহ) খাদি কাপড় নিয়ে (বড়কামতার চাঁন্দারপাড়ে) কাজ করেছেন। খাদিকে জনপ্রিয় করতে এবং তার প্রসার ঘটাতে অনেক ত্যাগ-তীতিক্ষাও তার ছিল। শৈলেন্দ্রনাথ গুহকে খাদির জনকও বলা হয়। খাদির প্রসারে ১৯৫২ সালে সমবায় আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লায় ‘দি খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাষ্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা কুমিল্লার বিখ্যাত খদ্দর কারখানা শৈলেন্দ্রনাথ গুহের গ্রামীন খদ্দর পরিদর্শনে আসেন। ঢাকাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে খদ্দরের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। কুমিল্লার ঐতিহ্য হিসেবে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা কুমিল্লায় এসে কুমিল্লার ঐতিহ্য খ্যাত খাদি বস্ত্র এবং কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই না কিনে ফেরেন না। ১৯৯৬ সালে খাদি’র জনক শৈলেন্দ্রনাথ গুহ অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি চেয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজ হাতের তৈরী একটি খদ্দরের শাড়ি উপহার দেবেন। কিন্তু তার শেষ ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি। ওই সময়ে সেখানেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
এক সময় খাদি সকলের পরিধেয় হলেও বিশেষ করে নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র মানুষ মোটা ভাতের সাথে মোটা কাপড় হিসেবে খাদির ব্যবহার ছিল গতানুগতিক। আর বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্রসহ দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের আভিজাত্যের পোশাক খাদি। প্রায় শতবর্ষেরও বেশি সময় কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা, নবীয়াবাদ, জাফরাবাদ, সাইতলা, বাখরাবাদ, হাড়িখোলা. ভানী এবং চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া, কলাগাঁও, কুটুম্বপুর, হারং, বানিয়াচং, ভোমরকান্দি, বেলাশর, মধ্যমতলা, বাড়েরা, গোবিন্দপুর, ছয়ঘড়িয়া গ্রাম খাদির জন্য বিখ্যাত। এসবস্থানে চরকায় সুতা কেটে কাঠের তৈরি লোম মেশিনে খট খট শব্দে একের এর এক সুতার সাথে বুনন করে তৈরি হচ্ছে খাদি কাপড়। যার প্রতিটি সুতায় জড়িয়ে আছে বৃহত্তর ভারতবর্ষসহ বাংলার ঐতিহ্য। নিম্নবিত্ত বা সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের পরিধেয় মোটা সুতায় তৈরি সাদামাটা এই কাপড়। রাঙ্গামাটির কার্পাস তুলায় সুতা কেটে এ কাপড় তৈরি শুরু করা হয়েছিল। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যুগী সম্প্রদায়ই এই কাপড় তৈরির কাজে নিয়োজিত।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস